[ডিসক্লেইমারঃ চেষ্টা করব রেফারেন্স সহ লেখার জন্য। কোন কথা যদি শরিয়তের বাইরে যায় তাহলে সে ত্রুটি আমার এবং সংশোধনযোগ্য। এই লেখা যদি কেউ মনে করে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালদ্ধ মানে স্টেজগুলো আমি পার করে এসেছি তাহলে ভুল হবে। বিষ খেলে যে শরীরের ক্ষতি হয় সেটা জানার জন্য বিষ খাওয়ার দরকার নেই।]
লেখার শিরোনাম কতটুকু যৌক্তিক হল সে প্রশ্ন আসলে থেকেই যায়। কারণ সাধারণত আমাদের দেশে স্ত্রীদের বশ করতে হয় না। তারা এমনিতেই বশ থাকে। স্বামীকে ছাড়া থাকতে চায় না। দুই একটা ব্যতিক্রম সব কিছুতেই আছে।
হাদিসে এসেছে, ঐ ব্যক্তিই উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম। [মিশকাত, ৬ খণ্ড, হাদিস -৩১১৪] এই হাদিস অনুযায়ী যদি আমরা পরীক্ষা করি তাহলে কত জন পুরুষ যে পাশ করবে বলা মুশকিল। তবে আমার ধারনা সিংহভাগই ফেল করবে। কি হতে পারে এর কারণ?
১। অনেক পুরুষ আছে যারা স্ত্রীদের আসলে মানুষই মনে করে না। ঘরের আসবাব যা শোভা বর্ধন করে এবং কালের পরিক্রমায় পুরাতন হয়ে যায়-এমনটা মনে করে। আর পুরাতন আসবাবপত্র আমরা কি করি? অবহেলায় ফেলে রাখি বা পরিবর্তন করে ফেলি। তারাও স্ত্রীদের এমনটাই মনে করে।
২। বর্তমান যুগে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে এমন একটা মেয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা আমার সন্দেহ হয় যে কিনা, স্বামীর অংশীদারিত্বে আপত্তি করবে না। জায়েজ সম্পর্কই মেনে নিতে পারে না অনেকে, সেখানে সম্পর্ক যদি না জায়েজ হয় তাহলে তো কথাই নেই। এই নিয়ে সাংসারিক গণ্ডগোল লাগবে। আমি দেখেছি একজন পুরুষ যদি নিঃস্বার্থভাবে কোন অসহায় নারীর সহায়তা করতে যায় তাহলে ঘরের স্ত্রী প্রথম কয়েকদিন সহ্য করলেও পরে আর সহ্য করতে পারে না।
৩। স্ত্রীদের হাত খরচ দেবার ব্যাপারে আমরা যথেষ্ঠ কৃপণ। বিয়ের আগে-পরে পারিবারিক জীবনে অসুখী নারী-পুরুষরা সদ্য বিবাহিত পুরুষকে নানা ধরনের কু-পরামর্শ দিয়ে থাকে। তার মধ্যে একটা হল বউকে টাইট দিয়ে রাখা। যত বেশি টাইট দেয়া যাবে তত বেশি পুরুষত্ব জাহির থাকবে। আমরা মনে করে থাকি, “স্ত্রীকে হাত খরচ দেওয়া মানেই টাকার অপচয়, তার টাকার দরকারটা কি? কিছু লাগলে আমাকে বলবে, আমি কিনে দিব। অসুবিধাটা কি?” আত্মসম্মান আছে এমন যেকোন মানুষ একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর টাকা চাইতে লজ্জা বোধ করে। ছেলে একটু বড় হলে বাবার কাছে টাকা চায় না, লজ্জা পায়। জন্মদাতা পিতার কাছে চাইতে পারে না। তেমনি স্ত্রীরাও সংকোচ বোধ করে। বাড়ীতে কোণ ভিক্ষুক আসল,বাইরে কোথাও ঘুরতে গেলেন সেখানে তার কিছু টাকা দান করতে মন চাইল,কিন্তু দিতে পারল না। আপনি তার হাতে কোন টাকা দেন না। বাইরে কোথাও বেড়াতে গেলেন,রাস্তায় এক ভিক্ষুক দেখে তার মনে মায়া হল, বাচ্চাদের কাছ থেকে একটা ফুল কিনতে ইচ্ছে হল আপনার জন্য, আপনার বাচ্চার জন্য একটা খেলনা তার পছন্দ হল,এখন কি রাস্তায় সবার সামনে আপনার কাছে চেয়ে নিতে হবে? কেন এই লজ্জাটা তাকে দিয়ে নিজেকে তার কাছে ছোট করছেন ভাই?
৪। অন্যের সামনে স্ত্রীর কোন বিষয় নিয়ে হালকা রসিকতা করা উচিত না। আপনি নির্দোষ রসিকতাও করলেও আপনার স্ত্রী সেটা ভালভাবে নেবার সম্ভবনা কম। আর অন্যের সামনে তাকে কোনভাবে ছোট করা, কটু কথা বলা, বকা দেয়া ইত্যাদিতে কেমন রিএকশন দেখাবে সেটা এ থেকেই বোধগম্য। একান্তে হাজারটা ভুল ধরেন এতে সে মাইন্ড করবে না।
৫। মেয়েদের একটা অভ্যাস হল আপনার কথা মাটিতে পড়তে দিবে না। এর আগেই দু’টো কথা শুনিয়ে দিবে। একই কথার একাধিক মান হতে পারে। আপনি হয়ত বলেছেন একঅর্থে, সে নিয়েছে আরেক অর্থে। এসব ক্ষেত্রে ধৈর্য্য ধরে বুঝিয়ে বলতে হবে। উলটা-পালটা কথা শুনে মাথা গরম করা চলবে না।
৬। যে কোন সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য মাথা ঠাণ্ডা রাখা জরুরী। এক পক্ষ রাগ করলে আরেক পক্ষ চুপ থাকতে হবে। স্ত্রী দায়িত্ব যেহেতু স্বামীর উপর সেহেতু এই ব্যাপারে তাকেই অগ্রণী হতে হবে।
৭। মনে রাখতে হবে, মেয়েদের আবেগ বেশি, কান কথায় কান দেয়ার প্রবণতা বেশি। দশ লোক আপনার সম্পর্কে ভাল কিছু বললেও একজন যদি খারাপ কিছু বলে তবে আপনার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কাজেই এসব ক্ষেত্রে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে, যেসব পদক্ষেপ নিলে এসব কানকথা এড়ানো যায় কঠোরভাবে সেসব পদক্ষেপ নিতে হবে।
৮। সংসারে প্রত্যকের দায়িত্ব আলাদা ও নির্দিষ্ট। এখানে আমি ইসলাম যেসব দায়িত্ব দিয়েছে সেগুলোর কথা বলছি। স্ত্রী ভরণপোষণের দায়িত্ব স্বামীর, বাবা-মার খেদমত করার দায়িত্ব ছেলের। এখানে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই যে, ছেলে সারাদিন বাইরে কাজ করে বাবা-মার দায়িত্ব কিভাবে পালন করবে? “কিভাবে পালন” করার বিষয়টা ছেলেই ম্যানেজ করবে। কাজের লোক রেখে হোক, স্ত্রীকে অনুরোধ করে হোক, বাবা-মার কাছে মাফ চেয়ে হোক। বাবা-মার খেদমত করার জন্য স্ত্রীকে বাধ্য করা যাবে না। তার উপর জুলুম করা যাবে না। [বিস্তারিত জানতে “পারিবারিক জীবনে ইসলাম”-মাওলানা আশরাফ আল থানবী রঃ লেখা বইটি পড়া যেতে পারে]
৯। স্ত্রী যদি আলাদা থাকতে চায় তবে তার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা স্বামীর জন্য ওয়াজিব । অন্তত তার জন্য আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করতে হবে।[বিস্তারিত জানতে “পারিবারিক জীবনে ইসলাম”-মাওলানা আশরাফ আল থানবী রঃ লেখা বইটি পড়া যেতে পারে] যেখানে সে নিজের স্বামীর সাথে একান্তে সুখ-দুঃখের কথা বলতে পারে। এটাকে বাবা-মা, ভাই-বোন থেকে আলাদা করে ফেলার ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখার কোণ সুযোগ নেই। বরং আমি মনেকরি বাবা-মার উচিত বিয়ে করিয়ে ছেলেকে আলাদা করে দেয়া। লক্ষ করলে দেখা যায়, যৌথ ফ্যামিলিতেই ঝগড়া-বিবাদ, অশান্তি বেশি। বউ নিয়ে আলদা হওয়া মাত্র আর কোন ঝামেল নেই। যৌথ ফ্যামিলির অনেক সুবিধা আছে তবে সংসারে শান্তি তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
১০। সাংসারিক জিনিসপত্র আলাদা করা ও ব্যক্তি মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা ভাল। এমনকি গ্লাস, প্লেট কোনটা কার সেটাও পরিষ্কার করে দেয়া। বিশেষ করে স্ত্রী টাকা-পয়সা নিজের একাউন্টে রাখা ঠিক না। কারন কোন কারনে মারা গেলে ঐ টাকার বন্টনে ঝামেলা বাধবে।
১১। পুরুষরা একাধিক নৌকায় পা দিয়ে চলে এবং সব নৌকাকেই লক্ষের দিকে নিয়ে যেতে হবে। এক নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে আরেক নৌকা চালালে ইহকাল-পরকাল বরবাদ হবার সম্ভবনা। কাজেই বাবা-মার খেদমত করতে হবে, ভাই-বোনের দেখভাল করতে হবে, একই সাথে স্ত্রী উপর জুলুম করা যাবে না।
১২। স্ত্রী আপনার ব্যক্তিগত সম্পদ। কাজেই সে যেন আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে সময় দিতে পারে, সে ধরনের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা যেন তার হয় সে ব্যবস্থা আপনাকেই করতে হবে। ঘরের কাজে তাকে যথাসম্ভব সহযোগীতা করতে হবে। প্রয়োজনে বাড়তি কাজের লোক রাখতে হবে। সারাদিন ঘরের কাজ করতে করতে যদি ক্লান্ত থাকে তাহলে স্বভাবতই আপনার সাথে খোশগল্প করার মত মুড থাকবে না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজের কাজ নিজেই করতেন, কারও সেবার আকাঙ্ক্ষা করতেন না। তবে কেউ সেবা করতে চাইলে তাকে বাধাও দিতেন না মনে কষ্ট পাবে ভেবে। [এই হাদিস অনলাইনে পেয়েছি। রেফারেন্স দিয়েছে তিরমিযি শরীফের। তবে বুখারীর ১৭৭৭ নং হদিসেও (হামিদিয়া লাইব্রেরী) এর সমর্থন রয়েছে।]
১৩। স্ত্রীর জন্য সময় বের করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রতিদিন আছরের পর স্ত্রীদের সাথে সময় ব্যয় করতেন। [বোখারি, হামিদিয়া লাইব্রেরী, হাদিস নং ২০৬০]
১৪। সফরের সময় স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। এতে ভালবাসা বাড়ে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লটারির মাধ্যমে স্ত্রীদের মধ্য হতে তার সফর সঙ্গী নির্ধারন করতেন। [বোখারী, হামিদিয়া লাইব্রেরী, হাদিস ২০৫৭] বছরে একবার হোক, দুই বছরে একবার হোক, পাচ বছরে একবার হোক কোথাও ঘুড়তে যাবেন। নিজেরও ভাল লাগবে, নিজেদের মধ্যে ভালবাসাও বাড়বে ইনশাআল্লাহ।
১৫। সন্তান যেন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। অনেক সময় কোণ কোণ সন্তান এত বিরক্ত করে যে, স্বামী স্ত্রীর সাথে মেলামেশা সুযোগ পায় না। এই সময়টাতে মেয়েদের বিশেষ যত্নের দিকে নজর দিতে হবে। স্বার্থপরের মত শুধু নিজেরটা ভাবলে চলবে না। বিয়ের প্রথম প্রথম যে কাজগুলো অতি রোমান্টিকতার সাথে করা হত [কবিতা লেখা, বই পড়া, হাসি ঠাট্টা ইত্যাদি] সন্তান বড় হলে অনেকে লজ্জায় সেগুলো বাদ দেয়, ব্যস্ততা তো আছেই। আগের মত প্রকাশ্যে করতে না পারলেও গোপনে করা উচিত। দামি দামি উপহারের চেয়ে আপনার এইগুলো স্ত্রীর কাছে অধিক ভালবাসার।
১৬। কাজের ফাঁকে ফাঁকেও স্ত্রীকে টাইম দেয়া উচিত। এখন ফেসবুকের কল্যানে এটা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। মজার কোন লেখা পেলেন, লিংক দিয়ে দিলেন ইনবক্সে; অহেতুক একটা মেসেজ দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন “কি রান্না হয়েছে আজকে?”। শুধু তাকে বুঝিয়ে দেয়া যে, কাজের মাঝে থাকলেও তোমার কথা ভুলে যাই নি।
১৭। আমাদের অভ্যাস হল কাজের সময় বাসা থেকে ফোন আসলে আমরা ঝাড়ি দেই। খুবই বাজে অভ্যাস এটা। বরং ৩০ সেকেন্ড হলেও কথা বলে বুঝিয়ে দেয়া উচিত “এখন কথা বলতে পারব না”।
১৮। সফর থেকে চট করে ঘরে ফেরা (সারপ্রাইজ) উচিত না, বিশেষ করে রাতে। এ ব্যাপারে হাদিসে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। আগে থেকেই খবর দিয়ে আসা উচিত। [বোখারি-২০৭১,২০৭২,২০৭৩, হামিদিয়া লাইব্রেরি]
১৯। স্বামীর জন্য সাজ-সজ্জা করে এমন নারী কম। আর স্ত্রীর জন্য পরিপাটি থাকে এমন পুরুষ তারও কম। স্ত্রীকে যেমন আপনি পরিপাটি দেখতে চান, স্ত্রীও আপনাকে তেমনি দেখতে চায়। এদিকেও খেয়াল রাখা জরুরী।
অনেক কথা লিখলাম। আরও লেখা যায়। তবে যে মানবে তার জন্য এটাই যথেষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ। মানলে কি লাভ হবে সে ব্যাপারেও দু’টো কথা লিখি।
১। সংসারের অশান্তি হবার সম্ভবনা কমে যাবে।
২। পরিবারের জন্য খরচ করলে আল্লাহর কাছে প্রতিদান পাওয়া যায়।[রিয়াদুস সালেহীন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৩৭]
৩। অন্য নারীর সাথে মেলামেশা করলে যদি গোনাহ হয় তবে স্ত্রী সাথে মেলামেশা এমনকি কথা বললেও সওয়াব হবে নিশ্চিত।
আর আমাদেরতো সওয়াবেরই দরকার, ঠিক না ভাই?
No comments:
Post a Comment